সোমবার, ১৮ জুন, ২০১২

গৌরনদীতে নিপা খুনিদের ফাঁসির দাবিতে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ : লাশ সৎকার

                               
  গৌরনদী  থেকে মোঃ বদরুজ্জামান খান
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার দোনারকান্দি গ্রামে যৌতুকের বলি কিশোরী গৃহবধু নিপা রানীর লাশ রোববার গভীর রাতে বাপের বাড়িতে সৎকার করা হয়েছে। নিপার খুনিদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে রোববার সন্ধ্যায় এলাকাবাসী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।
সরেজমিনে এলাকাবাসীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বখাটে দিপঙ্করের প্রতি অন্ধ ভালবাসার টানই কাল হল উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল অজপাড়া’গা খ্যাত দোনারকান্দি গ্রামের কিশোরী গৃহবধূ নিপা অধিকারী (১৫)র জীবনে। উশৃংখল ও বখাটে দিপঙ্কর সরকারের ভালবাসার দাম হিসেবে পাষন্ড স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ী কর্তৃক তার উপর ধার্য করা হয়েছিল ২ লাখ টাকা। পিতার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা এনে দিতে রাজি না হওয়ায় বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় গত শনিবার রাতে পাষন্ড স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের  নির্যাতনের মুখে নিজের জীবন দিয়ে ভালবাসার দাম দিতে হয়েছে তাকে।
সোমবার বিকাল ৫টার দিকে  সরেজমিনে অধিকারী’র বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিহত কিশোরী গৃহবধূ নিপা রানীর পিত্রালয়ের উঠানে জড়ো হয়ে এলাকার শতাধিক নারী পুরুষ নিপার শোকাচ্ছন্ন পিতা মাতাকে শান্তনা দিচ্ছে। সাংবাদিকদের উপস্থিতি বুঝতে পেরেই তারা সকলেই নিপা’র খুনিদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাড়ে ৭ টা পর্যন্ত এ প্রতিনিধিসহ স্থানীয় তিন সাংবাদিকের সাথে  ওই গ্রামে কথা হয় নিহত গৃহবধুর স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী ও এলাকার জন প্রতিনিধিদের সাথে। তারা সকলেই এক বাক্যে বলেন, দিপঙ্কর এলাকার বখাটে ও উৎশৃখল ছেলে। তাদের পরিবারের কেউই ভাল লোক না। নিপার হত্যাকারী দিপঙ্কর, তার পিতা, মাতাসহ পুরো পরিবারটির কঠিন সাজা হওয়া উচিৎ। আমরা ওদের ফাঁসি চাই। নিপার দাদা হরিবর অধিকারী (৮৫) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার নিস্পাপ নাতনীকে যারা খুন করেছে  আমি যেন বেচে থাকতে ওই খুনিদের ফাঁসি দেখে যেতে পারি ভগবানের কাছে এই প্রাথর্ণা করছি। কথা হয় ওই এলাকার মনোরঞ্জন ঢালী (৫০), নির্মল মলি¬ক (৪৫), অরুন করাতি (৪৮), নিখিল মলি¬ক (৪৫). সেন্টু সরদার (৪৯), শুশিলা অধিকারী (৭০), মিনতী গাইন (৩৮), আলোরানী হালদার (৫০), স্বরজনী অধিকারী (৮০),র সঙ্গে। তারা সকলেই নিপার খুনিদের ফাঁসির দাবি করেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য অনিল মলি¬ক বলেন, ওই গ্রামের নির্মল অধিকারী মোটামুটি স্বচ্ছল গৃহস্থ। গৃহস্থলী কাজের মধ্যে স্ত্রী উর্মিলা অধিকারী ও ৩ কন্যা মিতু অধিকারী (১৬), নিপা অধিকারী (১৪), অতশী অধিকারী (১০) ও ১ পুত্র শাওন অধিকারী (১২)কে নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল তার দিন। ৪ সন্তান নিয়ে সুখের সংসারের মেঝ কন্যা নিপার বয়স ১৪ বছর হলেও তার দৈহিক গঠনে সে বেশ বড় হয়ে ওঠে। এ কারণে প্রতিবেশী বখাটে যুবক দিপঙ্করের নজরে পরে নিপা ওপর।  জেএসি পরীক্ষার্থিনী কিশোরী নিপা (১৫) গত এক বছর পূর্র্বে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২১ মে প্রেমের টানে বখাটে প্রেমিক প্রতিবেশী দিপংকর সরকার (২০) এর হাত ধরে পিতার ঘর থেকে সাড়ে ৪ ভরি স্বর্নালংকার নিয়ে উধাও হয়ে যায়। অনেক খোজাখুজির পর নিপার পিতা জানতে পারেন প্রতিবেশী দিন মজুর শ্রীকৃষ্ণ সরকারেরর বখাটে পুত্র দিপঙ্কর সরকার (২৪) তার কন্যা নিপাকে নিয়ে পালিয়েছে। ঘটনার ২ দিন পর ওই বছরের ২৩ মে নিপার পিতা বাদী হয়ে দিপংকর ও তার পিতা-মাতাসহ  ৭ জনকে আসামি করে বরিশাল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন। আদালতের ওযারেন্ট পেয়ে পুলিশ পাশ্ববর্তী কালকিনি উপজেলার রাজার চর গ্রামের এক নিকট আত্বীয়ের বাড়ি থেকে অপহৃত নিপাকে উদ্ধার ও দিপঙ্করকে গ্রেফতার করে। আদালতের বিজ্ঞ বিচারক দিপঙ্ককরকে জেল হাজতে ও ভিকটিম নিপাকে সেফ কাষ্টডিতে পাঠিয়ে দেন। এর ১৫/২০ দিন পর আদালত দিপঙ্করকে জামিন দেয়। ভিকটিম নিপা প্রায় তিন মাস সেফ কাষ্টডিতে থাকার পর তার পিতার জিম্মায় জামিন পেয়ে পিত্রালয়ে ফিরে আসে। এরপর পিতার আশ্রয়ে কয়েক দিন কাটানোর পর নিপা পুনঃরায় বখাটে দিপঙ্করের হাত ধরে পিত্রালয় থেকে পালিয়ে যায়। নিপার পিতা তখন নিপাকে উদ্ধারে অরেকটি মামলা দিলে দিপঙ্কর আদালতে হাজির হয়ে ওই মামলাতে জামিন পেয়ে যায়। কিন্তু নিপাকে আদালত জামিন না দিয়ে পূর্ণঃরায় সেভ কাষ্টডিতে পাঠিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত বখাটে দিপঙ্কর স্থানীয় টাউটদের পরামর্শ নিয়ে নিপার পরিবারকে জব্দ করতে নিপাকে বাদী বানিয়ে তার পিতা নির্মল অধিকারী, মাতা উর্মিলাসহ পরিবারের  সদস্যদের বিরুদ্ধে নিপার গর্ভের একটি ভ্রুন হত্যার মিথ্যা মামলা দেওয়ায়। এ ঘটনার পর এলাকার মাতুব্বর প্রবীর মলি¬কেে আহব্বানে গ্রাম্য মাতুব্বররা উভয় পরিবারকে নিয়ে একটি গ্রাম্য সালিশ বৈঠকে বসে। মাতুব্বর হেমন্ত অধিকারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সালিশ বৈঠকে হরিপদ মলি¬ক, অবিনাশ সরকার, প্রবীর মলি¬¬ক, চিত্তরঞ্জন সরকারসহ ৮জ  গ্রাম্য মাতুব্বর উপস্থিত ছিলেন। কয়েকজন। সালিশ বৈঠকে স্থানীয় মাতুব্বররা উভয় পরিবারকে সামাজিক ভাবে মিলিয়ে দিয়ে দু পক্ষের মামলা তুলে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
নিপার পিতা শোকাহত নির্মল অধিকারী অভিযোগ করেন, সালিশ বৈঠকের বিচারের রায় মেনে নিয়ে তিনি নিপার জামিনে সহয়তা করে তাকে স্বামীর গৃহে ফেরার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু তার বখাটে স্বামী দিপঙ্কর নিপাকে হাতে পেয়ে আমাকে ও আমার স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের জব্দ করতে আমাদের বিরুদ্ধে নিপাকে দিয়ে করানো ভ্রুন হত্যার মিথ্যা মামলাটি তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। দিপঙ্কর ও তার পরিবারের সদস্যরা মামলার খরচ বাবদ নিপাকে আমার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা যৌতুক নিতে বলে। এ নিয়েই প্রথম শুরু হয় দিপঙ্করের সাথে নিপার পারিবারিক কলহ। যৌতুকের টাকার দাবিতে আমার মেয়েকে প্রায়ই মারধর করত দিপঙ্কর। ঘটনার দিন গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে স্বামী দিপঙ্কর ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন মামলার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমার কাছ থেকে নিপাকে ২ লাখ টাকা যৌতুক এনে দিতে বলে নিপার সাথে পিড়াপিড়ি শুরু করে। দাবিকৃত যৌতুকের ২ লাখ টাকা এনে দিতে রাজি না হলে স্বামী দিপঙ্কর সরকার, শ্বশুর শ্রীকৃষ্ণ সরকার, শাশুড়ী রিতা রানীসহ পরিবারে অন্যান্য সদস্যরা মিলে নিপাকে মারধর করতে থাকে। এ সময় নিপার ডাক চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরাসহ আমরা ছুটে গেলে আমাদেরকে ঘরে ঢুকতে বাধা দিয়ে দিপঙ্কর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর নিপার উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে নিপা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। শ্বশুর পরিবারের লোকজন তখন তাকে রিকশাভ্যানে তুলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে রওনা হয়। পথিমধ্যে নিপা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তখন শ্বশুর বাড়ির লোকজন নিপা বিষ পানে আতœহত্যা করেছে বলে এলাকায় প্রচারনা চালায়। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে নিপার লাশ তার শ্বশুর বাড়ির উঠানে ফেলে রেখে তার স্বামী দিপঙ্করসহ শশুর পরিবারের লোকজন গাঢাকা দেয়। আমরা ঘটনা যানতে পেরে ওই রাতে ঘটনাস্থলে এসে মেয়ের লাশ উঠানে পরে থাকতে দেখি।  পুলিশকে খবর দিলে ওই রাতেই নিপার লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পরদিন রোববার সকালে আমার ছোটভাই পরিমল অধিকারী বাদী হয়ে নিপার ঘাতক স্বামী দ্বিপঙ্কর সরকার, শ্বশুর শ্রীকৃষ্ণ সরকার, শাশুড়ী রিতা রানী, আত্মীয় বিপ¬ব সরকার, সুভাষ সরকারসহ ৬ জনকে  আসামি করে গৌরনদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
ছবির ক্যাপশন-
গৌরনদীঃ সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে উপজেলার দোনারকান্দি গ্রামের গৃহবধূ নিপার পিত্রালয়ের উপস্থিত শতাধীক গ্রামবাসী খুনিদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবি জানান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন