রবিবার, ৬ মে, ২০১২

ওদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন. . . .


মিজানুর রহমান  : লিটন সরদার, লালু সরদার, আল-আমিন সরদার, কিসলু গাজী, নান্টু সরদার ও এমরান আকনসহ ৯জন সবাই বাক প্রতিবন্ধি। তবুও থেমে নেই ওদের জীবন, ওদের ভাষা ওরাই বোঝে, সৃষ্টিকর্তা ওদের কথা বলার বাক স্বাধীনতা না দিলেও বিনোদন, গল্প বলা, আড্ডা, ছবি আকা প্রভৃতি চলছে সাধারণ মানুষে মতই। কাজের ভিন্নতা থাকলেও একসাথে হয়ে সুখ-দুঃখের ভাগাভাগিতে যেন কোন কার্পণ্য নেই। ওরা একসাথে থাকলে প্রত্যক্ষদর্শীরা চেয়ে থাকে আর ভাবে কত মিল ওদের মধ্যে। সবার বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার একই এলাকায়। ওদের প্রতি সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহব্বান জানিয়েছে ওই বাকপ্রতিবন্ধি পরিবারের সদস্যরা।

গত রবিবার বিকালে উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের কয়ারিয়া ঈদগাহ ময়দানের হাট ভ্যানষ্ট্যান্ডে এই ৯জন বাক প্রতিবন্ধিকে ইশারায় মনের ভাব আদান প্রদান করতে দেখা যায়। এই ইউনিয়নের পাশাপাশি গ্রামে তাদের বাড়ি। বাক প্রতিবন্ধি হয়েও বিভিন্ন কাজে এরা পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। কাজ শেষে তারা প্রায় দিনই বিকালে একসাথে মিলিত হন।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের ছোটচর কয়ারিয়া এলাকার মতিন সরদারের ছেলে লিটন (১৫) জন্মের পর কখনো কথা বলতে পারেননি। কথা না বলতে পারলেও মা-বাবার সংসারে বোজা হয়ে থাকেন নি। শৈশব থেকেই বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ভ্যান চালিয়ে উপার্জণ করছেন। মাঝেমধ্যে ব্যানার, ফেস্টুন, প্লেকার্ড, সাইনবোর্ড প্রভৃতি বিভিন্ন আঙ্গিকে লিখে আয় করে থাকেন। পাশের এলাকা ময়দানের হাটের ছত্তার সরদারের ছেলে লালু সরদারও (২৫) বাক-প্রতিবন্ধি হয়ে জন্ম গ্রহন করেন। অন্যান্য শিশুর মত বিদ্যালয়ে যেতে না পেরে লেখা-পড়া শেখার স্পৃহা মন থেকে মুছে দিতে পারেননি। তিনি সাধারণ বিষয়াদি লিখতে পারেন। তিনি এখন ভ্যান চালিয়ে জীবিকার্জণ করছেন। বড়চর কয়ারিয়া গ্রামের কাশেম মোল্লার ছেলে আল-আমিন মোল্লা (২৫) জন্মের পর কথা বলতে পারেননি। মনের অনুভ’তি আজো কাউকে বুঝাতে পারছেন না। ইচ্ছা থাকলেও বিদ্যালয়ে যেতে পারেননি। বাবা-মার অভাবী সংসারে তিনি বসে নেই। কৈশোর থেকেই ভ্যান চালিয়ে আয় করে সংসার চালাচ্ছেন। ভ্যান চালানোর সময় হাতের ইশারায় বা আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেন। অনেক সময় মায়ায় পড়ে যাত্রীরা ২/৩ টাকা বেশী দিয়ে থাকেন। ময়দানের হাট এলাকার মিজান গাজীর ছেলে কিশলু গাজীও (১৮) বাকপ্রতিবন্ধির অভিশাপ নিয়ে জন্ম গ্রহন করেছেন। কথা না বলতে পারলেও কখনো তিনি কঠোর পরিশ্রম থেকে বিরত থাকতে পারেননি। তিনি একজন দক্ষ কাঠের মিস্ত্রি। নৌকা, বাড়িঘর ও আসবাবপত্রসহ কাঠ দিয়ে তিনি বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করতে পারেন। এই কাজ করে তিনি প্রতিদিন ২০০টাকা থেকে ২৫০টাকা আয় করেন। একই গ্রামের আঃ হাকিম সরদারের ছেলে নান্টু সরদার (৪০) পৃথিবীতে আগমনের পর আজ পর্যন্ত কারো সাথে কথা বলতে পারেননি। সৃষ্টিকর্তার দয়া চাইতে হচ্ছে তাকে অন্তর দিয়ে। মানুষকে মনের আকাংক্ষা বুঝাতে হচ্ছে হাত, চোখ ও মুখের ইশারায়। তিনি ভিডিও এডিটিং এর কাজ করতে পারেন। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও করার কাজ পান। কৃষি কাজ হচ্ছে তার প্রধান পেশা। কাজের টাকা সংসারের জন্য ব্যয় করেন। একই গ্রামের হোসেন আকনের ছেলে এমরান আকন (৩০) জন্ম নিয়ে মা-বাবা বলে কোন দিন ডাকতে পারেননি। এ নিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ক্ষোভের অন্ত নেই তার। ময়দানের হাটে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে দর্জির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সংসারের আয় জোগাচ্ছেন অন্যান্য সদস্যদের মতই।

তাদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কারো সাথে কথা বলতে না পারায় ওরা ৯জন প্রত্যেক দিন বিকালে কাজ শেষে একসাথে মিলিত হয়। একসাথে যখন ওরা মনের কথা ইশারায় অন্যজন বুঝায় তখন মায়ায় পড়ে যায় সাধারণ মানুষ। কিন্তু আশ্চায় এই পৃথিবীতে তাদের মায়ায় পড়েনি উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা। ভোট না দেয়ায় সাবেক চেয়ারম্যার জাকির হোসেন বঞ্চিত করেছেন প্রতিবন্ধি প্রতিবন্ধি ভাতা থেকে। প্রতিবন্ধি ভাতার কার্ডের জন্য প্রতিবন্ধির সনদ সংগ্রহ করেও লাভ হয়নি। ভাতার কার্ডের জন্য ইউপি চেয়ারম্যান ও পরিষদ সদস্যদের  (মেম্বার) কাছে অনেক দিন ধরণা দিয়েও কার্ড পাননি। তাই তারা প্রতিবন্ধি ভাতার কার্ড পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বাক প্রতিবন্ধি পরিবারগুলোর সাথে আলাপকালে তারা বিত্তবানদের কাছে সাহায্য-সহযোগীতা কামনা করেছেন।

কয়ারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মোল্লা বলেন, প্রতিবন্ধি ভাতা পাওয়া থেকে ওদের বঞ্চিত করা প্রতারণার শামিল। উপজেলা প্রশাসনের সহযোগীতা পেলে অচিরেই তাদের প্রতিবন্ধি ভাতার কার্ড দেয়া হবে।

বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র পাল বলেন, আমাদের সমাজে অনেক সম্পদশালী লোক রয়েছে। তাদের একটু সহানুভ’তি এই বাকপ্রতিবন্ধি অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন